ভূয়া মশার কয়েলে বাজার সয়লাব,মশা মরে না,মরে মানুষ ! 1249 0
ভূয়া মশার কয়েলে বাজার সয়লাব,মশা মরে না,মরে মানুষ !
পীযুষ প্লাবন:
ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি পণ্যের নাম ‘মশার কয়েল’।ভ্যাপসা গরম ও মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহর থেকে শুরু করে প্রত্যান্ত অঞ্চলের মানুষ কয়েল ব্যবহার করে থাকে।আর একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায় অধিক মুনাফার আশায় প্রকাশ্যে বিক্রি করছেন অনুমোদনহীন নকল ও নিম্নমানের মশার কয়েল।চিকিৎসকদের মতে,কয়েল তৈরীতে একটি রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করতে হয় যেটি হলো অ্যালেট্রিন।এই অ্যালেট্রিন মস্তিষ্ক ও রক্তের ভেদ্যতা বাড়িয়ে দেয়।এটি যেকোন বয়সের জন্য ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি ও স্লো পয়জনিং।চিকিৎসকগণ বলেন,১টি মশার কয়েল ১০০টি সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।ঢাকা,নারায়ণগঞ্জ সহ গাজীপুরে অনুমোদনহীন মশার কয়েলে সয়লাব হয়ে গেছে।বাজারে নিম্নমানের কয়েলের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি বা কোনো মনিটরিং লক্ষ করা যাচ্ছে না।অন্যদিকে এসব কয়েল কোম্পানি ভুয়া পিএইচপি নম্বর ও বিএসটিআই’র লোগো ব্যবহার করে আকর্ষণীয় মোড়কে কয়েল বাজারে বিক্রি করছে।বিএসটিআইয়ের নকল ব্যান্ডের ট্রেডমার্ক দিয়ে কয়েল উৎপাদন করে দেশীয় কয়েলের প্যাকেট ব্যবহার করে তা বাজারজাত করে আসছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।বিদ্যমান বালাইনাশক অধ্যাদেশ (পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ ও পেস্টিসাইড রুলস ১৯৮৫) অনুসারে, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক।অধ্যাদেশ অনুযায়ী অধিদফতরের অনুমোদন পাওয়ার পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বালাইনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে।বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মশার কয়েলে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৩ মাত্রার ‘অ্যাকটিভ ইনটিগ্রেডিয়েন্ট’ ব্যবহার নির্ধারণ করেছে।এই মাত্রা শুধুমাত্র মশা তাড়াতে কার্যকর, মারতে নয়।কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়,অনুমোদনহীন
ব্যবসায়ীমহল কর্তৃক প্রস্তুত ও বাজারজাতকৃত কয়েলে শুধু মশাই নয়,বিভিন্ন পোকামাকড়,তেলাপোকা এমনকি টিকটিকি পর্যন্ত মারা যায়! ঢাকা,নারায়ণগঞ্জ,ও গাজীপুর জেলার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে,‘নাইট রোজ,ঝিলিক,ঝিলিক সুপার,সেরা,সেরা নিম,অতন্ত্র প্রহরী জাম্বো,অতন্ত্র প্রহরী মিনি,ফ্যামিলি,ওয়ান টেন,সান পাওয়ার,তুলসি পাতা,সাঝের তারা,বস,মশার জম রকেটসহ অনুমোদনহীন কয়েলে বাজার সয়লাব।ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার স্থাণীয় বাসিন্দা কয়েল বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম বলেন,কয়েল বিক্রি করে সংসার চালাই,কোনটা ভাল কোনটা মন্দ সেটা বুঝি না,তবে যেটা বেশি লাভ হয় সেটাই বিক্রি করি।নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি এলাকার বাচ্চু মিয়া কয়েল ব্যবহারকারী বলেন,মশার জ্বালায় ছেলে মেয়েরা ছটপট করে,বাধ্য হয়ে কয়েল জ্বালাই,যতক্ষণ জ্বলে ততক্ষণ মশা মরে,কিন্তু বাচ্চাগুলো অস্থির হয়ে যায়,খুকথুক করে কাঁশতে থাকে আর বলে নিশ্বাস নিতে কষ্ঠ হয় ।গাজীপুর মেট্রোপলিটন গাছা-বোর্ড বাজার এলাকার বাসিন্দা মামুন বলেন,মশা নয় মানুষ মারার কয়েল।স্বল্প দামের কয়েলের ধোঁয়াতে ঘর অন্ধকার হয়ে যায়।যেন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।মশাও মরে,সঙ্গে তেলাপোকাও।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) মশা তাড়ানোর কয়েলে শূন্য দশমিক ১ থেকে শূন্য দশমিক ৩ মাত্রার ‘অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট’ নামক কীটনাশক ব্যবহার নির্ধারণ করেছে।এ মাত্রার কীটনাশক ব্যবহার হলে মশা পালিয়ে যাওয়ার কথা।কিন্তু চিন-থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত ও বাংলাদেশে প্রস্তুত কিছু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্রেতা আকৃষ্ট করতে অতিমাত্রার কীটনাশক ব্যবহার করছে।এতে মশাসহ বিভিন্ন পোকামাকড়,তেলাপোকা এমনকি টিকটিকিও মারা যাচ্ছে।আর নিঃশ্বাসে বিষাক্ত ধোঁয়া গ্রহণে ধীরে ধীরে নানাবিধ রোগ বাসা বাঁধছে মানবদেহে।মশার কয়েলে মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার করায় শিশুর বিকাশ কমে যেতে পারে। বড়দের স্মৃতিভ্রম,ঝাঁকুনি,মানসিক দৃঢ়তা,মাথাব্যথার মতো সমস্যা হতে পারে।বিষাক্ত উপাদান শরীরের ইমিউন সিস্টেমের ক্ষতি করে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়,থাইরয়েড সমস্যাসহ বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষতি করে।এছাড়া লিভার ও কিডনি বিকল হওয়া,অ্যালার্জিসহ নানাবিধ চর্মরোগ সৃষ্টি করতে পারে।রোগতত্ত্ব,রোগ-নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক কতৃপক্ষ জানান,অনুমোদিত কিছু ক্ষুদ্র মশার কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক মেশানোর কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন ভোক্তারা।মানুষের শরীরে দানা বাঁধছে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ হাঁপানি,এমনকি ফুসফুস ক্যানসার পর্যন্ত।বিশেষজ্ঞদের মতে,আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ কীটনাশক বা কেমিক্যাল মেশানো হলে মশা তাড়ানোর কয়েল অনেক ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে মানবদেহে নানা রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।এ ধরনের রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার সব বয়সী মানুষের জন্যই ক্ষতিকর।তবে শিশুদের ওপর এটি দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে।প্রতিনিয়ত এ ধরনের রাসায়নিকের সংস্পর্শ তাৎক্ষণিকভাবে নয়,সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে। জটিল রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করে।বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত ও রক্তে বিষক্রিয়া হয়।এতে গর্ভের শিশুও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বালাইনাশক অধ্যাদেশ-(পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ ও পেস্টিসাইড রুলস ১৯৮৫) অনুসারে মশার কয়েল উৎপাদন,বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক।অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কয়েলের নমুনা পরীক্ষা করে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতর ‘পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট’ (পিএইচপি) নম্বর অনুমোদন দেবে।এরপর পিএইচপি কাগজপত্র দেখে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন মিললেই কেবল বালাইনাশক পণ্য হিসেবে মশার কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করা যাবে।কিন্তু বাজারের অধিকাংশ মশার কয়েলের পিএইচপি নম্বর থাকলেও বিএসটিআইয়ের অনুমতি নেই।কোনোটিতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন থাকলেও পিএইচপি নম্বর নেই।আবার কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে ভুয়া পিএইচপি নম্বরে অনুমোদন নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বাজারে যেসব কয়েল পাওয়া যায়, তাতে যে মাত্রায় ইনগ্রিডিয়েন্ট ব্যবহার করা হয়,তা এখন খতিয়ে দেখার বিষয়।এসব কয়েল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মান যাচাই করা এখন সমযের দাবী ।এছাড়াও কয়েল ব্যবহারকারীরা মনে করেন দেশের বাইরে থেকে মশার কয়েল আমদানির ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গঠনে গুরুত্বারোপ করা দরকার।আমাদের দেশে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মশার কয়েল প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে,যারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নামে ভোক্তাদের ঘরে জায়গা করে নিয়েছে এবং তারা যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া দিয়ে অনুমোদন পেয়েছে।এখানে চাইলেই অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলো রাসায়নিক মিশ্রণ বাড়াতে পারে না,যা দ্রুত মশা মেরে ফেলবে কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য তা মারাত্মক ক্ষতিকর।ঠিক এ সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত রাসায়নিক মিশ্রণের মাধ্যমে উৎপাদন ও বাজারজাত করে চলেছে বিষাক্ত মশার কয়েল।অতিরিক্ত মিশ্রণ থাকায় এর তাৎক্ষণিক কার্যক্ষমতা অল্প সময়েই ভোক্তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে যারমরণ ফাঁদে নিজেরাই আটকে দিচ্ছে স্বাভাবিক জীবনের গতি ।